নিজের প্রতিষ্ঠিত মাদরাসায় শিক্ষকতায় ব্যস্ত থাকতেন মুফতি ইব্রাহীম খলিল। পাশাপাশি জড়িত ছিলেন ইসলামি রাজনীতিতেও। হঠাৎ তার কর্মব্যস্ত জীবন স্তব্ধ করে দেয় পতিত আওয়ামী সরকারের আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। বিনা অপরাধে কুষ্টিয়া থেকে আটকের পর নেওয়া হয় রাজশাহী ডিবিতে। দুই মাস গুম রেখে অমানুষিক নির্যাতনের পর গ্রেপ্তার নাটক সাজিয় দেওয়া হয় ভিত্তিহীন মামলা।
এ সময় নানাভাবে নির্যাতন ও ক্রসফায়ারের হুমকি দিয়েও জঙ্গি কার্যক্রমে জড়িত থাকার স্বীকারোক্তি না দেওয়ায় ১৮ মাস কারাগারের অন্ধকার জগতে কাটাতে হয় ইসলামী ঐক্যজোটের যশোর জেলার সাবেক এই সেক্রেটারিকে। পুলিশি হয়রানি থেকে রেহাই পায়নি তার পরিবারও। আর আদালত ও থানা-পুলিশ করতে গিয়ে প্রায় ২৪ লাখ টাকা খরচ করে অনেকটা নিঃস্ব হয়ে পড়েছেন তিনি। জামিনে মুক্তির পরও বহাল ছিল পুলিশি হয়রানি। ৫ আগস্ট-পরবর্তী জীবনযাত্রায় স্বস্তি ফিরলেও থামেনি মামলার হাজিরার ভোগান্তি।
যশোরের ঝিকরগাছা উপজেলার পারবাজারে জামিয়া আরাবিয়া কওমি বালক-বালিকা মাদরাসার প্রতিষ্ঠাতা পরিচালক মুফতি ইব্রাহীম খলিল। হেফাজতে ইসলাম বাংলাদেশ ঝিকরগাছা থানার সেক্রেটারিও তিনি। আওয়ামী সরকারের আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর হাতে আলেম-ওলামা নির্যাতনের ধারাবাহিকতায় নিজের কিছু করুণ অভিজ্ঞতা আমার দেশ-এর কাছে তুলে ধরেছেন তিনি।
২০২০ সালের ২ নভেম্বর কুষ্টিয়ায় এক বন্ধুর মাদরাসা উদ্বোধনে যোগ দিতে সকালে যশোরের চাঁচড়া মোড় থেকে বাসে উঠেছিলেন মুফতি ইব্রাহীম। একই গাড়িতে ওঠেন আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সাদা পোশাকধারী ১০-১৫ জন সদস্য (পরে নিশ্চিত হন)। বাসটি কুষ্টিয়ায় পৌঁছানোর পর দুপুর ১২টার দিকে মজমপুরে স্ট্যান্ডে নামেন।
সেখানে তাকে রিসিভ করতে আসা বন্ধু হাফেজ মাওলানা হাসানের সঙ্গে রিকশায় করে মাদরাসাটির কাছাকাছি পৌঁছানোর আগেই শহরের কমলাপুর নামক স্থানে পেছন থেকে ইব্রাহীম ভাই বলে ডাক দেওয়া হয়। তারা বলেন, আমরা প্রশাসনের লোক, কোনো আওয়াজ করবেন না। এ বলেই তাদের দুজনকে পাঁজাকোলা করে ধরে সাদা মাইক্রোবাসে উঠিয়ে নিয়ে যায়। গামছা দিয়ে তাদের মুখ ও চোখ বেঁধে সাত-আট ঘণ্টা গাড়ি চালিয়ে নিয়ে যায় রাজশাহীতে।
মুফতি ইব্রাহীম জানান, আমাকে রাজশাহীর ডিবি অফিসের দোতলায় ‘ইন্টারোগেশন সেলে’ নিয়ে চোখ খুলে দেয়। আর বন্ধুকে রাখা হয় আরেক স্থানে। ওই রুমে কোনো জানালা ছিল না। দরজা সব সময় লাগানো থাকত। সে সময় খুব গরম আবহাওয়া ছিল। কোনো পাখা, বালিশ কিছুই দেয়নি। দুই সপ্তাহ পর আবার শীত শুরু হয়। তখনো দেওয়া হয়নি কোনো কম্বল।
সেখানে বাথরুমে যাওয়ার সময়ও চোখ বেঁধে হাতে হ্যান্ডকাফ লাগিয়ে নিয়ে যেত। সার্বক্ষণিক পাহারায় থাকত দুই পুলিশ। তার গায়ে কোনো গেঞ্জি-জামা ছিল না। শুধু লুঙ্গি পরা অবস্থায় জিজ্ঞাসাবাদের জন্য একটি রুমে নিয়ে যাওয়া হতো।
এ সময় হাঁটুতে আঘাত করত তারা। রাত ১টা, ২টা, ৩টার সময় ডাকত। এমনও হয়েছে, রাতে তিন-চারবার করে নিয়ে যায় সেখানে। বলত যে, আপনার কাছে অস্ত্র আছে, কাগজে যা যা লেখা আছে তার স্বীকারোক্তি দিতে হবে। নইলে আজই আপনার শেষ দিন। আমি বলতাম, আপনারা ভালোভাবে যাচাই-বাছাই করুন, এসবের সঙ্গে আমি জড়িত নই।
মুফতি ইব্রাহীম বলেন, ডিবির রুমটির দেয়ালে রক্তে লেখা নাম, মোবাইল নম্বর ও কষ্টের কথা চোখে পড়ত। সেখানে তাকে জিজ্ঞাসাবাদ করতেন নতুন নতুন অফিসার। মাঝেমধ্যে রাতে চোখে কালো কাপড় বেঁধে ও হাতে হ্যান্ডকাফ পরিয়ে বাইরে নিয়ে যেত এবং বলত আজকে আপনার শেষ রাত, আপনি প্রস্তুত হন। শারীরিক ও মানসিক নির্যাতন করত। তারা তার কাছ থেকে হাস্যকর বিষয়ে স্বীকারোক্তি আদায়ের চেষ্টা করত। যেমনÑ ‘আমার কাছে এক ট্রাক অস্ত্র আছে, আমি শেখ হাসিনা হত্যাচেষ্টার জন্য গ্রেনেড সরবরাহ করেছি’, ‘দ্বিতীয় আরেকটি গ্রেনেড আমার কাছে আছে’, ‘যেকোনো সময় জঙ্গি হামলা করে বাংলাদেশ দখল করার পরিকল্পনা করছি’ ইত্যাদি।
এভাবে দুই মাস গুম রেখে নির্যাতনের পর গ্রেপ্তার নাটক সাজায় পুলিশ। এ প্রসঙ্গে মুফতি ইব্রাহীম বলেন, ৩০ ডিসেম্বর ২০২০ রাত ২টার দিকে পুলিশ এসে আমাকে কোমরে একটা বেল্ট পরতে দেয়। বলে, রেডি হন আজকে আপনাকে নিয়ে যাব।
আজকে আপনার শেষ, ফাইনাল দিন। হয় আপনাকে ক্রসফায়ার দেব, নইলে ছেড়ে দেব। আর না হয় মামলা দেব। এরপর রাত ২টা থেকে ৪টা পর্যন্ত আমাকে নিয়ে বিভিন্ন জায়গায় ঘোরায়। নোমান নামে নোয়াখালীর আরেকটি ছেলেকেও একইভাবে দুই মাস গুমের পর আমার সঙ্গে নিয়ে আসে। আর তার সেই বন্ধু হাসানকে ছেড়ে দেওয়া হয়।
গ্রেপ্তার নাটকের বর্ণনা দিয়ে তিনি বলেন, ‘আমাদের দুজনকে রাত ৪টার দিকে রাজশাহীর মতিহার থানার খড়খড়িয়া বাজার (বাইপাস) এলাকায় ইজিবাইকে চড়িয়ে পাঠানো হয়। কিছুদূর যাওয়ার পর গতিরোধ করে পুলিশ। আমাদের সঙ্গে রাখা ব্যাগে কিছু ধর্মীয় বই বের করে বলে এরা জঙ্গি, এরা নাশকতা করার জন্য, দাওয়াতি কাজের জন্য ঢাকা থেকে এসেছে।
এভাবে আমাদের আটক করে পুলিশ কমিশনারের কার্যালয়ে নেওয়া হয়। পরদিন সকালে সেখানে সংবাদ সম্মেলনের মাধ্যমে জঙ্গি মামলায় গ্রেপ্তারের বিষয়টি জানায় পুলিশ। সেখানে আগে থেকেই র্যাব, ডিবি, কাউন্টার টেরোরিজমের এক-দেড় শ সদস্য ছিলেন। এ সময় বলা হয়, আমি জঙ্গি অর্থায়ন করি। দুবাই থেকে লাখ লাখ টাকা এনেছি। আমি রাজশাহী ও খুলনা বিভাগের কমান্ডার। অথচ আমি জীবনে রাজশাহী যাইনি। খুলনা শহরে জীবনে দু-এক দিন গিয়েছি।
দুই মাস পর পরিবারের সদস্যরা জানতে পারেন যে তিনি বেঁচে আছেন। তার মাধ্যমে পরিবারকে ফোন দিয়ে কোর্টে আসতে বলা হয়। তিনি তার স্ত্রীকে ফোন দিয়ে শ্যালক ও অন্যদের আসতে বলেন। কোর্টের মাধ্যমে ফের পাঁচ দিনের রিমান্ডে নেয় পুলিশ।
রিমান্ড শেষে আলাদতে তোলার আগে আমাকে মুখস্থ করার জন্য একটি কাগজ দেওয়া হয়, ম্যাজিস্ট্রেটের সামনেও ঠিক একই কাগজ দেওয়া হয়। ম্যাজিস্ট্রেট আমাকে কাগজটি দেখিয়ে ঠিক আছে কি না জানতে চান। আমি বলি এগুলো কিছুই ঠিক নেই। তখন তিনি একটি সাদা কাগজে সই নেন। পরে দেখি আমার বক্তব্য নেই, পুলিশের সেই বক্তব্যই লেখা হয়েছে। আমাকে জেলে পাঠানোর আদেশ দেয় আদালত।
এরপর আরও ১৮ মাস রাজশাহী কারাগারে কাটাতে হয় এই মাদরাসা শিক্ষককে। এ সময় মাত্র দুদিন কোর্টে তোলে তারা। সাত মাস কারাভোগের পর হাইকোর্ট থেকে জামিন লাভ করলেও তা স্থগিত করে দেওয়া হয়। ১৮ মাসের মাথায় আরেকবার জামিন হলে মুক্তির জন্য জেলগেট পর্যন্ত নিয়েও ফেরত পাঠানো হয়। দুদিন পর সংশ্লিষ্টদের টাকাপয়সা দিয়ে বের হন তিনি। এ মামলা পরিচালনা করতে গিয়ে প্রায় নিঃস্ব হয়ে গেছেন এই আলেম।
এ প্রসঙ্গে মুফতি ইব্রাহীম বলেন, এ মামলা চালাতে গিয়ে তার প্রায় ২৪ লাখ টাকা খরচ হয়ে গেছে। এ কথা এত দিন কারও কাছে বলারও সুযোগ হয়নি। তিনি বলেন, গুম থাকা দুই মাসে তাকে খোঁজাখুঁজি করতে গিয়েই খরচ হয়েছে ৪ লাখ টাকা। দুই মাস তার সন্ধান না পেয়ে পরিবারের সবার পাগল হয়ে যাওয়ার মতো অবস্থা। দেশের এমন কোনো জেলখানা নেই, যেখানে খোঁজাখুঁজি করেননি তারা।
তার খোঁজ চেয়ে এক সপ্তাহের মাথায় যশোরে সংবাদ সম্মেলন করা হয়। বিভিন্ন এলাকার চেয়ারম্যান-মেম্বার, পুলিশ প্রশাসনের সঙ্গে যোগাযোগ করেছেন তার ভাইপো। কোনো সন্ধান পায়নি তারা। দুই মাস পরও সন্ধান পাওয়ার পরও তাকে ছাড়াতে পুলিশকে অনেক টাকা দিতে হয়। ঝিকরগাছা থানা, ঢাকার ডিবিসহ বিভিন্ন অফিসে এসব টাকা দেওয়া হয়।
মুফতি ইব্রাহীম জানান, কাউন্টার টেরোরিজমের এডিসি একরামুলের নেতৃত্বেই তাকে কুষ্টিয়া থেকে রাজশাহী নিয়ে যাওয়া হয় এবং তার তত্ত্বাবধানেই শেষ পর্যন্ত ছিলেন তিনি।
তিনি বলেন, কোনো অপরাধ তিনি করেননি। তবে ইসলামী ঐক্যজোটের নেতা হিসেবে সে সময় যশোরে বিভিন্ন মিছিল-মিটিংয়ে তিনি সোচ্চার ছিলেন। হেফাজতে ইসলামের সঙ্গেও জড়িত ছিলেন তিনি।
গ্রেপ্তার-নির্যাতনের প্রভাব পড়ে তার পরিবারের ওপরও। মুফতি ইব্রাহীম জানান, তার স্ত্রী পর্দানশিন, কারও সামনে যেতেন না। কিন্তু তাকে অনেকভাবে হয়রানি করেছে পুলিশ। যেকোনো সময় প্রয়োজনে ডাকত পুলিশ, এমনকি রাতেও ডাকা হতো। এ সময় চরম আর্থিক কষ্টে পড়ে তার পরিবার। প্রয়োজন মেটাতে বাড়ির এক খণ্ড জমি বিক্রি করে দেয়। এ ছাড়া বিভিন্নভাবে ঋণ নিয়ে সংসার ও মামলা চালায় তারা। জেল থেকে বের হওয়ার পরও সাত-আট লাখ টাকা ঋণী ছিলেন তিনি।
মুক্তির পরও তাকে স্বস্তিতে থাকতে দিত না পুলিশ। গভীর রাতেও তার বাসায় আসত ঝিকরগাছা থানা-পুলিশ। তল্লাশির পাশাপাশি নানা কথাবার্তা বলত। এতে আতঙ্কে ঠিকমতো ঘুম হতো না। সন্তানদের নিয়েও টেনশন হতো।
৫ আগস্টের পর সেই পরিস্থিতি কেটে গেছে। তবে এখন সমস্যা রাজশাহীর আদালতে হাজিরা দেওয়া নিয়ে। গত ৭ জানুয়ারিও তিনি হাজিরা দিয়ে এসেছেন। এতে যাতায়াত কষ্টের পাশাপাশি আর্থিক খরচ মেটানো তার জন্য দুষ্কর হয়ে পড়েছে। ভিত্তিহীন এ মামলা থেকে দ্রুত অব্যাহতি চান তিনি।
Leave a Reply