বিএসএফের গুলিতে নিহত কিশোরী ফেলানী হত্যার বার্ষিকী আজ। ভারতীয় সীমান্তরক্ষী বাহিনী বিএসএফ ২০১১ সালের ৭ জানুয়ারি কিশোরী ফেলানীকে নির্মমভাবে হত্যা করে। বাবার সঙ্গে সীমান্ত অতিক্রমের সময় তাকে লক্ষ্য করে খুব কাছ থেকে গুলি ছোড়ে বিএসএফ। এরপর কাঁটাতারের বেড়ায় ঝুলতে থাকে তার লাশ। ফেলানী হত্যার এই ছবি বিশ্বজুড়ে তোলপাড় সৃষ্টি করে। হত্যাকারী বিএসএফ সদস্য অমিয় ঘোষ বিএসএফের বিশেষ আদালতে নিজের দোষ স্বীকার করলেও তাকে বেকসুর খালাস দেওয়া হয়।
বিএসএফের বিশেষ আদালতের এই রায়ের বিরুদ্ধে ভারতের সুপ্রিম কোর্টে আপিল করে ফেলানীর বাবা নুর ইসলাম ও পশ্চিমবঙ্গের মানবাধিকার সংগঠন মানবাধিকার সুরক্ষা মঞ্চ (মাসুম)। আপিলের শুনানির তারিখ নির্ধারণ করা হয়েছে আজ মঙ্গলবার, ৭ জানুয়ারি ফেলানী হত্যার বার্ষিকীর দিন।
ফেলানীর বাবা নুর ইসলাম আমার দেশকে বলেন, বিএসএফের আদালতে তার মেয়ে হত্যার বিচার হয়নি। এ কারণে তিনি আপিল করেছেন। এই মামলার অন্য আপিল আবেদনকারী মানবাধিকার সংগঠন মাসুমের সেক্রেটারি কিরিটি রায় জানান, চিফ জাস্টিসের বেঞ্চে মামলাটি এসেছে। উকিলের সঙ্গে কথাবার্তা বলে মনে হচ্ছে, শুনানি না হওয়ার সম্ভাবনাই বেশি। তিনি বলেন, পৃথিবীজুড়ে মান্যতা আছে জাস্টিস ডিলেড জাস্টিস ডিনাই এ ক্ষেত্রে তাই হচ্ছে।
২০১৩ সালের ১৩ আগস্ট ভারতের কোচবিহারে বিএসএফের বিশেষ আদালতে ফেলানী হত্যার বিচার শুরু হয়। ৬ সেপ্টেম্বর অভিযুক্ত বিএসএফ সদস্য অমিয় ঘোষকে বেকসুর খালাস দেয় আদালত। বিজিবির আপত্তিতে ২০১৪ সালের ২২ সেপ্টেম্বর পুনর্বিচার শুরু হলেও সেখানে খালাস দেওয়া হয় অভিযুক্ত অমিয় ঘোষকে। এরপর ২০১৫ সালের ১৪ জুলাই ভারতীয় মানবাধিকার সুরক্ষা মঞ্চের (মাসুম) মাধ্যমে ফেলানীর বাবা নুর ইসলাম উচ্চ আদালতে রিট পিটিশন দাখিল করেন। পিটিশনের ভিত্তিতে কয়েক দফায় শুনানির দিন পিছিয়ে এখনও আদালতেই ঝুলে আছে পিটিশনটি। এর মধ্যে অমিয় ঘোষ কলকাতা হাইকোর্টে তার বিচার না করার জন্য আরেকটি রিট করেছেন।
ফেলানীর বাবার আইনজীবী আব্রাহাম লিংকন বলেন, আসামি নিজে স্বীকার করেছেন তিনি খুন করেছেন। আদালত যখন আত্মস্বীকৃত খুনিকে পরিত্রাণ দেয়, তখন তা প্রহসন হয়। এ রায়ে ভারতের বিচারব্যবস্থা প্রশ্নবিদ্ধ হয়েছে। আব্রাহাম লিংক জানান, এই মামলার জন্য তারা দুবার ভারতে গিয়েছেন। কিন্তু রায়ের কোনো কপি পাননি। বিচার প্রক্রিয়া দেখার সুযোগ দেওয়া হয়নি। তাদের সাক্ষ্য নিয়ে তড়িঘড়ি করে বর্ডার পার করে দেওয়া হয়। তিনি বলেন, মামলার আসামি বিএসএফ, বাদী বিএসএফ, প্রসিকিউশন ও বিচারকও বিএসএফ। ফলে এখানে ন্যায়বিচার পাওয়ার কোনো সম্ভাবনা ছিল না।
আব্রাহাম লিংকন জানান, ফেলানী হত্যা যে অন্যায় ও অপরাধ ছিল, তা ভারতের মানবাধিকার কমিশন স্বীকার করেছে। ভারতের মানবাধিকার কমিশন বলেছিল, যতই যুক্তি দেওয়া হোক না কেন, একজন কিশোরীকে এভাবে হত্যা করা আইনসম্মত নয়। কমিশন ফেলানীর পরিবারকে ৫ লাখ রুপি ক্ষতিপূরণ দিতে বলেছিল।
ফেলানী হত্যায় ভারত ও শেখ হাসিনা দায়ী: রাশেদ প্রধানফেলানী হত্যায় ভারত ও শেখ হাসিনা দায়ী: রাশেদ প্রধান
ফেলানীর বাবা সেদিনের মেয়ে হত্যার স্মৃতিচারণ করে আমার দেশকে বলেন, ২০১১ সালের ৬ জানুয়ারি মেয়েকে সঙ্গে করে আসেন ফুলবাড়ীর অনন্তপুর সীমান্তে। মেয়েকে বিয়ে দেওয়ার জন্য আসাম থেকে বাড়িতে আসছিলেন তিনি। খুব ভোরে তারা দালালের মাধ্যমে সীমান্তে কাঁটাতারের ওপর মই বেয়ে পার হওয়ার চেষ্টা করছিলেন। তখনও সকাল হয়নি, ঘন কুয়াশায় অনেকটা অন্ধকার। মই বেয়ে কাঁটাতারের বেড়া পার হওয়ার জন্য ফেলানীকে আগে তুলে দেন। মেয়ের হাত ধরে রেখেছিলেন তিনি। এ সময় গুলি করে বিএসএফ। গুলি এসে লাগে মেয়ের বুকে। এরপর বিএসএফ সদস্যরা দৌড়ে চলে আসেন। তিনি হামাগুড়ি দিয়ে কিছুদূর চলে যান। অপেক্ষার পর ভোরের আলোতে দেখেন লাল সুয়েটার পরা মেয়ের লাশ ঝুলে আছে কাঁটাতারের বেড়ায়। নুর ইসলাম বলেন, পরের দিন মেয়ের বিয়ের দিন ঠিক করা ছিল। বিয়ের জন্য সোনার কানের দুল বানিয়ে ছিলাম। সেগুলো পরা ছিল। লাশের সঙ্গে তা আর পাওয়া যায়নি।
এদিকে ফেলানীর মতো নিয়মিতভাবে সীমান্তে বাংলাদেশি নাগরিক হত্যা করে চলছে বিএসএফ। মানবাধিকার সংগঠন অধিকারের হিসাবে ২০০৯ সাল থেকে এ বছরের নভেম্বর পর্যন্ত ১৫ বছরে ৫৮৮ বাংলাদেশিকে হত্যা করেছে বিএসএফ। আহত হয়েছেন ৭৭৩ জন। বিএসফের পক্ষ থেকে সীমান্ত হত্যা শূন্যে নামিয়ে আনার প্রতিশ্রুতি দেওয়া হলেও তা বাস্তবায়িত হয়নি। বিএসএফ বিশ্বজুড়ে ট্রিগার হ্যাপি বাহিনী হিসেবে পরিচিতি পেয়েছে। যারা বিচারবহির্ভূত উপায়ে নিয়মিত বাংলাদেশি নাগরিকদের হত্যা করছে।
Leave a Reply