গত দেড় দশকে ব্যাংক ও আর্থিক খাত থেকে ৫৭ হাজার কোটি টাকা একাই লুটেছেন হাসিনার দরবেশ সালমান এফ রহমান। নামে-বেনামে ব্যাংকসহ ১৮৮টি প্রতিষ্ঠান থেকে এ টাকা লুট করেছেন তিনি। আমার দেশ-এর অনুসন্ধানে বেরিয়ে এসেছে এ তথ্য।
অনুসন্ধানে পাওয়া গেছে, দরবেশ সালমান ব্যাংক থেকে হাতিয়েছেন ৫০ হাজার কোটি টাকা এবং পুঁজিবাজার থেকে নিয়েছেন ৭ হাজার কোটি টাকা। ব্যাংক থেকে ঋণের নামে নেওয়া এসব অর্থের মধ্যে ২৩ হাজার ১২০ কোটি টাকা এখন খেলাপি। শুধু তার মালিকানাধীন প্রতিষ্ঠানই নয়, বেনামি কোম্পানি খুলে সালমান ব্যাংক খালি করেছেন।
আর্থিক খাতের এই ‘দরবেশ’ আওয়ামী লীগের ১৫ বছরের শাসনামলে ছিলেন ধরাছোঁয়ার বাইরে। সালমানের ক্ষমতার প্রভাবে রাষ্ট্রায়ত্ত জনতা ব্যাংক একেবারে ধসে পড়েছে। জনতা থেকে সালমান লুটেছেন ২৪ হাজার কোটি টাকা। সোনালী, আইএফআইসি, রূপালী, ন্যাশনাল ও এবি ব্যাংক থেকে হাতিয়েছেন ২০ হাজার কোটি টাকা। ঋণের নামে এমন ব্যাংক লুটেরা সালমানের কারণে আর্থিক খাত হোঁচট খেয়েছে, তবে তার বিরুদ্ধে টুঁ শব্দটিও করেননি হাসিনা সরকারের সংশ্লিষ্টরা।
বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক প্রধান অর্থনীতিবিদ মোস্তফা কে মুজেরী আমার দেশকে বলেন, ‘রাজনৈতিক ছত্রছায়ায় ব্যাংক-বিমাসহ যত আর্থিক প্রতিষ্ঠান আছে, সবগুলোই পারস্পরিক যোগসাজশে লুট করা হয়। শুধু ব্যাংক লুটের মধ্যেই থেমে থাকেননি সালমান, দেশের শেয়ারবাজার নিয়ন্ত্রণে নিতে ব্যবহার করেছেন নিয়ন্ত্রক সংস্থা সিকিউরিটি এক্সচেঞ্জ কমিশনকে। কেন্দ্রীয় ব্যাংকে সালমানের ছিল ব্যাপক প্রভাব।
যাকে যে পদে চেয়েছেন, সেখানেই বসিয়েছেন সালমান। আবার সরিয়েও দিয়েছেন নিজের স্বার্থে। তিনি বলেন, ‘রাজনৈতিক ছত্রছায়ায় লুটপাটের কারণে আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলো এখন ভঙ্গুর অবস্থায়। তাই এখান থেকে সহজে মুক্তি সম্ভব হচ্ছে না। আবার গত সাড়ে ৫ মাসেও যে ধরনের কঠোর পদক্ষেপ নিয়ে উত্তরণ করার দরকার ছিল, সেটাও দেখা যাচ্ছে না। ফলে মূল্যস্ফীতি ও ব্যাংক খাতসহ কোনো খাতেই গুণগত পরিবর্তন চোখে পড়ছে না। সঠিক ও কঠোর পদক্ষেপ নেওয়া না হলে মুক্তি পাওয়া সম্ভব হবে না।’
সালমানের প্রভাবে ধসনামা জনতা ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) মজিবর রহমান আমার দেশকে বলেন, ‘ঋণ আদায়ে সরকার ও বাংলাদেশ ব্যাংকের সঙ্গে আলোচনা চলছে। রিসিভার আছেন, তিনিও টাইম টু টাইম সরকারের সঙ্গে আলোচনা করছেন। ব্যাংকের পক্ষ থেকে আইনিভাবে প্রস্তুতি নেওয়া হয়েছে। আশা করি ভালো কিছু হবে।’
বেক্সিমকোর ঋণের বিষয়ে সোনালী ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) মো. শওকত আলী খান বলেন, ‘বেক্সিমকোর কয়েকটি ইউনিটের ঋণ রয়েছে। বড় একটি অংশ খেলাপি হয়ে গেছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের নিয়ম অনুযায়ী কোনো গ্রুপের একটি প্রতিষ্ঠান খেলাপি হলে বাকিগুলো ঋণ পায় না। এসব বিষয় নিয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের সঙ্গে আলোচনা চলছে।’
যেভাবে লুটে নেওয়া হয় জনতার টাকা : রাষ্ট্রায়ত্ত জনতা ব্যাংক থেকে সালমানের ২৯টি প্রতিষ্ঠান ঋণের নামে লুটেছে ২৩ হাজার ৯১২ কোটি টাকা। এর মধ্যে ১৯ হাজার ৫০৭ কোটি টাকাই এখন খেলাপি। বেক্সিমকো গ্রুপের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে ঋণ দেওয়ার ক্ষেত্রে জনতা ব্যাংক সে সময় চাপে পড়ে কোনো নিয়মনীতির তোয়াক্কা করেনি। সালমান চাওয়া মাত্রই ঋণ দেওয়া হয়েছে। অনুসন্ধানে দেখা যায়, সালমানের প্রতিষ্ঠানকে ঋণ দেওয়ার ক্ষেত্রে আগে টাকা ছাড় দেওয়া হয়েছে, পরে সেই টাকার বিপরীতে কাগজপত্র তৈরি করে ঋণের খাতা খোলা হয়।
একক ঋণসীমা অতিক্রম হওয়ার পরও ব্যাংক প্রতিষ্ঠানটিকে নতুন ঋণ দেয়। এ ক্ষেত্রে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নির্দেশনা মানা হয়নি। এ ছাড়া কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নির্দেশনা লঙ্ঘন করে ২০২৩ সালের নভেম্বর মাসে প্রায় ৮ হাজার ৫৮০ কোটি টাকার ঋণ পুনঃতফসিল সুবিধা দেওয়া হয় সালমানকে। আবার বাংলাদেশ ব্যাংকের সঙ্গে ব্যাংকটির ২০২৩ সালের এমওইউ চুক্তি হয়। সে অনুযায়ী স্থানীয় কার্যালয়সহ পাঁচটি শাখার ঋণের পরিমাণ ব্যাংকের মোট ঋণের ৩০ শতাংশের নিচে নামানোর নির্দেশনা ছিল।
তবে ব্যাংক বেক্সিমকো গ্রুপকে নতুন ঋণ সুবিধা দিয়ে তা লঙ্ঘন করে। তাছাড়া ব্যাংকের তারল্য পরিস্থিতি ও প্রতিষ্ঠানের ঋণঝুঁকি বিবেচনায় না নিয়েও বেক্সিমকো গ্রুপের আটটি প্রতিষ্ঠানকে ঋণ দেয় ব্যাংক। ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদ কর্তৃক বেক্সিমকো গ্রুপের প্রকৃত খেলাপি ঋণ আড়াল করা হয়। আবার বেক্সিমকো গ্রুপ খেলাপি প্রতিষ্ঠান হলেও তাদের অনুকূলে নতুন ঋণ দেয় জনতা ব্যাংক, যা বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্দেশনার পরিপন্থী কাজ। এছাড়া একটি প্রতিষ্ঠানের জায়গায় আরেক প্রতিষ্ঠান দেখিয়ে ঋণ নেওয়ার মতো নজিরও খুঁজে পাওয়া যায় অনুসন্ধানে।
সূত্র জানায়, ব্যাংকটি থেকে নিয়মনীতি না মেনে টাকা বের করার জন্য নিজের পছন্দের চেয়ারম্যান এবং এমডি নিয়োগ দিতেন। পছন্দ না হলে নিয়োগপ্রাপ্ত ব্যক্তিকে ব্যাংকে যোগদান করতে দিতেন না। কেউ যোগদান করে ফেললেও অনিয়ম, দুর্নীতির অভিযোগ দিয়ে পদত্যাগে বাধ্য করাতেন সালমান।
বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের সাবেক সচিব হেদায়েত উল্লাহ আল মামুনকে জনতা ব্যাংকের চেয়ারম্যান নিয়োগ করা হলেও সালমানের পছন্দ না হওয়ায় তিনি যোগ দিতে পারেননি। একইভাবে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সাবেক পরিচালক ড. জামাল উদ্দিন আহমেদ জনতা ব্যাংকের চেয়ারম্যান হিসেবে যোগ দিলেও দুর্নীতির অভিযোগ তুলে তাকে পদত্যাগে বাধ্য করেন। এসব বিষয়ে নানা সময় প্রশ্ন করলেও নীরব থাকেন সালমান এফ রহমান।
তথ্য অনুযায়ী, সালমানের প্রতিষ্ঠান অ্যাডভেঞ্চার গার্মেন্টসের নামে নেওয়া হয় ৫৬৬ কোটি টাকা, পুরো ঋণ এখন খেলাপি। অ্যাপোলো অ্যাপারেলসে ৭৯৩ কোটি, অটামলুপ অ্যাপারেলসে ৭৭১ কোটি, বাংলাদেশ এক্সপোর্ট ইমপোর্ট কোম্পানির ১ হাজার ১৬৯ কোটি, বে সিটি অ্যাপারেলস ৮৯০ কোটি, বেক্সিমকো ফ্যাশনস ৯২৭ কোটি, বেক্সিমকো ফার্মাসিটিক্যাল ৩৫৫ কোটি, বেক্সিমকো পিপিই ১৭ কোটি, বেসটিকস গার্মেন্টস ৮৫৭ কোটি, কসমোপলিটান অ্যাপারেলস ৮৫৬ কোটি, কোজি অ্যাপারেলস ৮৬০ কোটি, ক্রিসেন্ট ফ্যাশনস অ্যান্ড ডিজাইন ১ হাজার ৫৩৯ কোটি, এসকপ অ্যাপারেলস ৭৫৫ কোটি, ইজি ফ্যাশন ১ হাজার ১৩৭ কোটি, ইন্টারন্যাশনাল নিটওয়্যার অ্যান্ড অ্যাপারেলস ১ হাজার ১৮৮ কোটি, ইন্টারন্যাশনাল নিটওয়্যার অ্যান্ড অ্যাপারেলস লিমিটেড (ইউনিট-২) ৬১৪ কোটি, কাঁচপুর অ্যাপারেলস ৭৫৫ কোটি, মিডওয়েস্ট গার্মেন্টস ৭৬১ কোটি, নিউ ঢাকা ইন্ডাস্ট্রিজ ৯৮১ কোটি, পিয়ারলেস গার্মেন্টস ৮০১ কোটি, পিঙ্ক মেকার গার্মেন্টস ৮৪৯ কোটি, প্লাটিনাম গার্মেন্টস ৮৩৫ কোটি, শাইনপুকুর গার্মেন্টস ৭৮২ কোটি, স্কাই নেট অ্যাপারেলস ৭৮৭ কোটি, স্প্রিংফুল অ্যাপারেলস ৭৫৯ কোটি, আরবান ফ্যাশন ৬৯৯ কোটি, হোয়াইট বে অ্যাপারেলস ৮৭২ কোটি, উইন্টার স্প্রিন্ট গার্মেন্টস ৭৬৭ কোটি এবং ইয়েলো অ্যাপারেলসের নামে ৯৬৮ কোটি টাকা ঋণ নিয়েছেন।
আইএফআইসি থেকে সাড়ে ১৩ হাজার কোটি টাকা লুট : সালমান এফ রহমান আইএফআইসি ব্যাংক থেকেও ঋণ বের করেন অস্তিত্বহীন প্রতিষ্ঠানের নামে। এই ব্যাংকের বিষয়ে অনুসন্ধান করে দেখা যায়, ব্যাংক থেকে টাকা লুটে নেওয়ার জন্য তিনি ২৯টি প্রতিষ্ঠান খোলেন ভুয়া কাগজপত্র দেখিয়ে। আর এসব প্রতিষ্ঠানের বিপরীতে প্রায় ১৩ হাজার ৪৬৩ কোটি টাকার ঋণ বের করেন তিনি।
প্রতিবেদন অনুযায়ী, শ্রীপুর টাউনশিপ প্রতিষ্ঠানের নামে ১ হাজার ২০ কোটি টাকা, সানস্টার বিজনেস প্রতিষ্ঠানের নামে ৬২৯ কোটি, ফারইস্ট বিজনেসের নামে ৬১৪ কোটি, কসমস কমোডিটিস লিমিটেডের নামে ৬২৯ কোটি, আলট্রন ট্রেডিং লিমিটেডের নামে ৪৬২ কোটি, সার্ভ কনস্ট্রাকশনের নামে ৪৭৮ কোটি, আলফা এন্টারপ্রাইজ লিমিটেডের নামে ৫১১ কোটি, অ্যাবসলিউট কনস্ট্রাকশন অ্যান্ড ইঞ্জিনিয়ারিং লিমিটেডের নামে ৪৭২ কোটি, প্রতিষ্ঠান ব্লু-মুন ট্রেডিং লিমিটেডের নামে ৬২১ কোটি, এভারেস্ট এন্টারপ্রাইজের নামে ৫৪৭ কোটি, গ্লোয়িং কনস্ট্রাকশন অ্যান্ড ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের নামে ৬৫৪ কোটি, ভিস্তা ইন্টারন্যাশনালের নামে ৪৮৬ কোটি, এক্সিস বিজনেস লিমিটেডের নামে ৬০১ কোটি, আসাদ ট্রেডিংয়ের নামে ৬৮৩ কোটি, বেক্সিমকো ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের নামে ২ কোটি, ব্রাইটস্টার বিজনেসের নামে ২৮৫ কোটি, সেন্ট্রাল হাইটস ঢাকার নামে ১৩৬ কোটি, সেন্ট্রাল ল্যান্ড বিল্ডিংয়ের নামে ৪১২ কোটি টাকা, কসমো কমোডিটিসের নামে ৬২৭ কোটি, ক্রাইস্টাল কনস্ট্রাকশনের নামে ৩৬৮ কোটি, গ্লোবাল এলপিজির নামে ৩৪৮ কোটি, নিউ ঢাকার নামে ১১৬ কোটি, কুইক রিয়েল এস্টেটের নামে ৬৪৫ কোটি, রাজ হাউজিং লিমিটেডের নামে ৩৪৬ কোটি, সৃষ্টি রিয়েল এস্টেটের নামে ৪০০ কোটি, স্কাইমার্কের নামে ৫৬৪ কোটি এবং টিমবিল্ড কনস্ট্রাকশনের নামে ৪৩৯ কোটি টাকার ঋণ রয়েছে।
অনুসন্ধানে দেখা যায়, ১৩টি প্রতিষ্ঠান খোলা হয় ২০২২ সালের জুন থেকে ডিসেম্বর মাসের মধ্যে। এসব প্রতিষ্ঠানকে এক থেকে দেড় মাসের মাথায় ব্যাংকটি তাদের আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে ঋণ অনুমোদন করা হয়। ঋণ অনুমোদনের ক্ষেত্রে ব্যাংকের পক্ষ থেকে ডিউ ডিলিজেন্স মেইনটেইন না করেই বিপুল পরিমাণ অর্থছাড় করা হয়। ছাড়কৃত অর্থের সদ্ব্যবহার করা হয়নি। এ ছাড়া আগের ঋণের সুদ আদায় না করে ব্যাংক নতুন করে ঋণসীমা বৃদ্ধি করেছিল। ঋণের অর্থ প্রতিষ্ঠানগুলো ব্যবসায়িক কাজে না লাগিয়ে বেক্সিমকো গ্রুপের অন্য প্রতিষ্ঠানে স্থানান্তর করা হয়। এসব ঋণের বিপরীতে কোনো ধরনের জামানত ছিল না। খেলাপি ঋণ করার নির্দেশ দিলেও ব্যাংক এখনও তা খেলাপি করেনি।
সূত্র জানায়, এসব ঋণ অনিয়মের মাধ্যমে দেওয়ার সঙ্গে বোর্ড ম্যানেজমেন্ট জড়িত ছিল। তাই তাদের কাছে সম্প্রতি বাংলাদেশ ব্যাংক ব্যাখ্যা চায়। জবাবে তারা জানায়, তাদের বিভিন্ন সময় নানা ধরনের ভয় দেখিয়ে এসব ঋণ নিয়েছে। আয়নাঘরের মতো বিষয় উল্লেখ করেও ভয় দেখানো হয়।
সম্প্রতি দুদকে ভুয়া এসব প্রতিষ্ঠানের অনুকূলে ক্ষমতার অপব্যবহার করে ঋণ দেওয়ায় অনিয়মের সঙ্গে জড়িত ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদের সাবেক চেয়ারম্যান সালমান এফ রহমান এবং ব্যাংকের সদ্য সাবেক ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও প্রধান নির্বাহী (পরবর্তী সময়ে ব্যাংকের অ্যাডভাইজর) শাহ আলম সারোয়ারের দায়দায়িত্ব নিরূপণ এবং স্বচ্ছতার ভিত্তিতে তাদের বিরুদ্ধে কঠোর ও দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি প্রদান নিশ্চিতকরণ এবং ঋণের সমুদয় অর্থ আদায় বা সমন্বয় করার লক্ষ্যে জরুরি ভিত্তিতে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করে তার অগ্রগতি কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সংশ্লিষ্ট বিভাগকে জানাতে বলা হয়েছে।
ad
সোনালী, অগ্রণী ও রূপালীতে সালমানের যত ঋণ : রাষ্ট্রায়ত্ত জনতা ব্যাংক ছাড়াও এ খাতের আরও তিন ব্যাংক থেকে ৩ হাজার ৬৫১ কোটি টাকার ঋণ বের করেন সালমান। এর মধ্যে সোনালী ব্যাংক থেকে চারটি প্রতিষ্ঠানের অনুকূলে ১ হাজার ৬৭৭ কোটি। এই ঋণের ১ হাজার ৫৪৪ কোটি টাকা এখন খেলাপি। অগ্রণী থেকে চার প্রতিষ্ঠানের অনুকূলে ১ হাজার ৯ কোটি এবং রূপালী ব্যাংক থেকে ৯৬৫ কোটি টাকার ঋণ নেন।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, সোনালী ব্যাংক থেকে নেওয়া ঋণগুলো পুনর্গঠিত। এসব ঋণ পুনর্গঠনের সুবিধা দেওয়ার আগে গ্রাহকের ব্যবসায়িক পরিকল্পনা ও আদায়ের সঠিক পরিকল্পনা যাচাই করা হয়নি। আবার প্রতিষ্ঠানের পরিশোধের সক্ষমতা এবং অন্য ব্যাংকের সঙ্গে সর্বশেষ দায় অবস্থাও বিবেচনায় নেওয়া হয়নি। সিআইবিতে ঋণের তথ্যও গোপন রাখা হয়। পুনর্গঠন-পরবর্তী সময় ডাউনপেমেন্টের বিষয়ে মিথ্যা দিয়ে ঋণটি পুনঃতফসিল ও সুদ মওকুফ সুবিধা দেওয়া হয়। দুবারের বেশি পুনঃতফসিল নেওয়ার নিয়ম থাকলেও, প্রতিষ্ঠানকে কয়েকবার সুযোগ দেওয়া হয়। এ ছাড়া প্রতিষ্ঠান খেলাপি হলেও তা খেলাপি দেখানো হয়নি।
রূপালী ব্যাংক এক ঋণগ্রহীতার যে সীমা ছিল, তা অতিক্রম করে ঋণ বিতরণ করেছে। নিয়ম অনুযায়ী, ফান্ডেড ও নন-ফান্ডেড মিলে একটি ব্যাংকের পরিশোধিত মূলধনের ২৫ শতাংশের বেশি হবে না।
ন্যাশনাল ব্যাংকের যত ঋণ : বেসরকারি খাতের ন্যাশনাল ব্যাংক থেকেও সালমান এফ রহমান নামে-বেনামে ঋণ বের করে নিয়েছেন। ৯টি প্রতিষ্ঠানের অনুকূলে ৩ হাজার ১৮২ কোটি টাকার ঋণ নেন তিনি। এসব ঋণের ১ হাজার ৫৯২ কোটি টাকাই এখন খেলাপি।
ন্যাশনাল ব্যাংক থেকে অ্যাপোলো ট্রেডিং প্রতিষ্ঠানের নামে ৭৯ কোটি, বাংলাদেশ এক্সপোর্ট ইমপোর্টে ১৬৭ কোটি, বেক্সিমকো অ্যাভিয়েশনে ৪৩ কোটি, বেক্সিমকো এলপিজি ইউনিট ১ ও ২ অনুকূলে মোট ১ হাজার ৩২৫ কোটি, এসকর্প অ্যাপারেলস ১৪৩ কোটি, জিএমজি এয়ারলাইনসে ২০২ কোটি এবং ইনডিপেনডেন্ট টিভির বিপরীতে ২১৯ কোটি টাকার ঋণ রয়েছে। এ ছাড়া চট্টগ্রাম-কক্সবাজার ডুয়েলগেজ রেললাইন নির্মাণ প্রকল্প সংশ্লিষ্ট সাব-কন্ট্রাক্টের বিপরীতে অনভিজ্ঞ ব্লুম সাকসেস ইন্টারন্যাশনালে ৯০৪ কোটি টাকার ঋণ দেওয়া হয়। এই ঋণগ্রহীতা প্রতিষ্ঠানের কোনো আর্থিক প্রতিবেদনও ছিল না।
ছয় প্রতিষ্ঠানের নামে এবি ব্যাংক থেকে নিয়েছেন ১ হাজার ৮৩৮ কোটি : এবি ব্যাংকে সালমান এফ রহমানের ছয় প্রতিষ্ঠানের মোট ঋণ এখন ১ হাজার ৮৩৮ কোটি টাকা। এই ব্যাংকের ঋণ অনেক পুরোনো হলেও, সালমান ব্যাংকে টাকা না দিয়েও খেলাপি হননি।
আমার দেশ-এর অনুসন্ধানে দেখা যায়, ছয়টি প্রতিষ্ঠানের মধ্যে একটি ট্রপিক্যাল ফ্যাশনস। প্রতিষ্ঠানটির আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে ইডিএফ সুবিধার আওতায় ৩০ মিলিয়ন বা ২৫৫ কোটি টাকার ব্যাক টু ব্যাক এলসি সুবিধা ও ৬ মিলিয়ন ডলার বা ৫২ কোটি টাকার রিভলভিং তলবি ঋণের অনুমোদন দেওয়া হয়। তবে ঋণ পরিশোধ না করায় গ্রাহকের অনুকূলে ফোর্সড লোন সৃষ্টি করা হয়। বর্তমানে ১২টি কিস্তি ওভারডিউ রয়েছে। ওভারডিউ বিবেচনায় গ্রাহক খেলাপি হলেও ব্যাংক খেলাপি থেকে মুক্ত রেখেছে।
আরও যত ব্যাংক : সালমান এফ রহমানের আরও পাঁচটি প্রতিষ্ঠানের অনুকূলে এক্সিম ব্যাংক থেকে ১ হাজার ৪৬৮ কোটি টাকার ঋণ সুবিধা নিয়েছে। এসব ঋণের ৩২৭ কোটি টাকা এখন খেলাপি। ডাচ্-বাংলা দুটি প্রতিষ্ঠানের অনুকূলে ১৭০ কোটি টাকার ঋণ দেয়, যার মধ্যে এখন ৯৩ কোটি টাকাই খেলাপি। ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী ব্যাংক ১৪৬ কোটি টাকা দেওয়া হয়। গ্লোবাল ইসলামী ব্যাংক থেকে ৮৫ কোটির মধ্যে ৫২ কোটি খেলাপি, পদ্মা ব্যাংকের ২৪ কোটি, উত্তরা ব্যাংকের ৪ কোটির পুরোটাই খেলাপি, ব্যাংক এশিয়ার ১ কোটির পুরো অংশই খেলাপি এবং ঢাকা ব্যাংকের ১৩৭ কোটি টাকার ঋণ রয়েছে।
ব্যাংকের টাকায় বেনামি শেয়ার কেনেন সালমান : পুঁজিবাজারের অন্যতম কারসাজির হোতা সালমান এফ রহমান। পুঁজিবাজারে তার কারসাজির কারণে গত তিন দশকে অনেক বিনিয়োগকারী পথে বসেছেন। গত কয়েক বছর ব্যাংক থেকে টাকা বের করে ব্যক্তি ও বেনামি প্রতিষ্ঠানের নামে শেয়ার কিনে কারসাজি করেন সালমান। সম্প্রতি আমার দেশ-এর এক অনুসন্ধানে বেরিয়ে আসছে তেমনি এক চিত্র। অনুসন্ধানে দেখা যায়, সালমান এফ রহমান ও তার ছেলে আহমেদ শায়ান ফজলুর রহমানসহ ৭৪ ব্যক্তি এবং তার বেনামি আট প্রতিষ্ঠানের নামে ৬ হাজার ৭৯৭ কোটি টাকার শেয়ার কেনা হয়। এসব শেয়ার কেনা হয় সাতটি ব্যাংক থেকে ঋণ বের করে। গত তিন থেকে চার বছরের মধ্যে শেয়ারগুলো কিনেছেন সালমান এফ রহমান। ইতোমধ্যে এসব শেয়ারের টাকা বাজেয়াপ্ত করেছে বাংলাদেশ ফাইন্যান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্সি ইউনিট (বিএফআইইউ)।
তথ্য অনুযায়ী, বেনামি প্রতিষ্ঠানগুলো হলো অ্যাবসলিউট কনস্ট্রাকশন, অ্যাপোলো ট্রেডিং, এআরটি ইন্টারন্যাশনাল, জুপিটার বিজনেস, ক্রিসেন্ট লিমিটেড, নিউ ঢাকা ইন্ডাস্ট্রিজ, সেন্ট্রাল ল্যান্ড অ্যান্ড বিল্ডিং এবং ট্রেড নেক্সট ইন্টারন্যাশনাল। ৭৪ জন ব্যক্তির পাশাপাশি এসব প্রতিষ্ঠানে শেয়ার রয়েছে।
এদিকে সালমান এফ রহমান জেলে থাকায় এসব বিষয়ে তার বক্তব্য নেওয়া সম্ভব হয়নি। বেক্সিমকো গ্রুপের একাধিক কর্মকর্তার সঙ্গে যোগাযোগ করা হলেও এসব বিষয়ে কেউ মুখ খোলেননি।
সুত্রঃ আমার দেশ
Leave a Reply