চট্টগ্রামের গুম হওয়া এক শিক্ষার্থী বন্দি জীবনে ভয়াবহ নির্যাতনের শিকার হয়েছেন। ৭৬ দিন গুম রেখে তাকে জঙ্গি তকমায় আদালতে হাজির করা হয়। এমনকি বাথরুমে যাওয়ার সময়ও চোখ বেঁধে নিয়ে যেত। নামাজ পড়ার সময়ও হ্যান্ডকাফ খুলে দিত না।
তিনি বলেন, ২০২০ সালের ২৬ জুলাই দোকান থেকে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্য পরিচয়ে অস্ত্রধারীরা তাকে মাইক্রোবাসে তুলে নিয়ে যায়। রাখা হয় চেয়ার, বেড ও জানালাবিহীন একটি রুমে। সেই রুমের দেয়ালে লেখা ছিল আগে গুম হওয়া ব্যক্তিদের বাঁচার নানা আকুতি। বাথরুমে যাওয়ার সময়ও চোখ বেঁধে নিয়ে যেত। সিভিল ড্রেসে দুজন পাহারায় থাকত।
ফ্যাসিস্ট আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে নিজের ওপর ভয়ংকর নির্যাতনের চিত্র দৈনিক আমার দেশের কাছে এভাবেই তুলে ধরেন ১৬ বছর বয়সে গুম হওয়া শিক্ষার্থী আবু ছাদেক। তিনি দক্ষিণ চট্টগ্রামের লোহাগাড়া উপজেলার পদুয়া ইউনিয়নের আবুল হাশেমের ছেলে ও বান্দরবান সরকারি কলেজের শিক্ষার্থী।
আবু ছাদেক জানান, পরের দিন তাকে চোখ বেঁধে হ্যান্ডকাফ লাগিয়ে গাড়িতে তোলে। আনুমানিক তিন ঘণ্টা গাড়ি চলার পর একজন তাকে জিজ্ঞেস করে যমুনা সেতু দেখবে কি না। চোখ খুলে দিলে দেখতে পান যমুনা সেতু। এরপর তাকে বগুড়া থানার একটি ভবনে নিয়ে যায়। ভবনের ওপরে লেখা ছিল ‘ইন সার্ভিস ট্রেনিং সেন্টার’। পরে চোখ খুলে দেয়।
তখন তিনি ছোট ছোট ‘আয়নাঘর’ দেখতে পান। ওখানে ছিল একটি লোহার সিট। সিটের সঙ্গে বাঁধা দুটি হ্যান্ডকাফ। একটির সঙ্গে আরেকটি জোড়া লাগানো। একটি সিটের সঙ্গে আরেকটি তার হাতে বাঁধে। নামাজ পড়ার সময়ও হ্যান্ডকাফ খুলে দিত না। এমনকি ঘুমানোর সময়ও হ্যান্ডকাফ পরিয়ে রাখত।
আবু ছাদেক আরও বলেন, সেখানে তাকে বিভিন্ন সময় রাতে ও দিনে জিজ্ঞাসাবাদ করত নতুন নতুন অফিসার। ১২ অক্টোবর তাকে একজন লোক এসে তাড়াতাড়ি রেডি হতে বললে তিনি রেডি হন। পরে তাকে হ্যান্ডকাফ পরিয়ে ও চোখ বেঁধে রুমে থেকে বের করে গাড়িতে তোলে।
চার থেকে পাঁচ ঘণ্টা চলার পর গাড়ি থেকে নামিয়ে তাকে আরেকটি গাড়িতে তোলে। চোখ খুলে দিলে দেখেন ভোর হয়েছে। একজন অফিসার এসে বয়স জানতে চাইলে তিনি বয়স ১৬ বছর জানালে অফিসার বলেন ১৯ বছর বলতে হবে। পরে চট্টগ্রাম কাউন্টার টেরোরিজম ইউনিটের সাইনবোর্ডের সামনে নিয়ে গিয়ে পিছনে হ্যান্ডকাফ লাগিয়ে আরও পাঁচজনসহ তার ছবি তোলে।
তিনি বলেন, এরপর তাদের ছয়জনকে নব্য জেএমবির সদস্য বানিয়ে লোহাগাড়া থেকে কাউন্টার টেরোরিজম ইউনিট গ্রেপ্তার করেছে উল্লেখ করে চট্টগ্রাম আদালতে তোলে। সেখানে চট্টগ্রাম নগরীর ২ নম্বর গেট এলাকায় ২০২০ সালের ২৮ ফেব্রুয়ারি ট্রাফিক পুলিশ বক্সে হামলার ঘটনায় তিনি জড়িত মর্মে স্বীকারোক্তি আদায়ের চেষ্টা করে।
আবু ছাদেক বলেন, তিনি ম্যাজিস্ট্রেটের কাছে মিথ্যা বলেননি। তারপর তাকে জঙ্গি মামলায় দীর্ঘ ১৮ মাস বন্দি করে রাখা হয়। এভাবেই বিনা কারণে ফ্যাসিস্ট শেখ হাসিনার পুলিশ ও গোয়েন্দা সংস্থার লোকজন মিলে তাকে জঙ্গি বানিয়ে ছাড়ে। টানা ৭৬ দিন গুম করে রাখার পর ১৮ মাস ৪ দিন তাকে বন্দি রাখা হয়। এর পর উচ্চ আদালত থেকে পরিবারের পক্ষে জামিন করানো হয়।
আবু ছাদেক এখন মামলার হাজিরা দিয়েই হয়রান। তার বিরুদ্ধে চট্টগ্রামে ও গাজীপুরে দুটি মামলা চলমান। গুম ও মিথ্যা মামলায় জড়িয়ে বন্দি করে রাখার বিষয়ে গুম কমিশনে অভিযোগও দাখিল করেছেন আবু ছাদেক।
তিনি বলেন, ২০২০ সালের ২৮ ফেব্রুয়ারি রাতে ষোলশহর ২ নম্বর গেট এলাকায় ট্রাফিক পুলিশ বক্সে বিস্ফোরণের ঘটনা ঘটে। তাকে বোমা হামলা করেছি মর্মে- স্বীকার করতে বলে পুলিশ। আর গুম থাকার বিষয়টি কাউকে বলতে নিষেধ করে। বললে মেরে ফেলবে বলে জানায়।
৫ আগস্ট ফ্যাসিস্ট হাসিনার পলায়নের পর অন্তর্বর্তী সরকারের গঠিত গুম কমিশনে অভিযোগ করেছেন তিনি। এখন তিনি বান্দরবান সরকারি কলেজে এইচএসসির ছাত্র। যারা তার জীবন থেকে দুটি বছর কেড়ে নিয়েছে, যারা জঙ্গি তকমায় গুম করেছিল তাদের বিচার কি হবে- এমন প্রশ্ন রাখেন ছাদেক।
Leave a Reply